শেখ মামুনূর রশীদ: সাম্প্রতিক উচ্চমাত্রার জঙ্গি সন্ত্রাস মোকাবেলায় দ্রুত জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা মনে করেন, মূলত রাজনৈতিক সংকটের কারণেই দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। এ সংকটের নেপথ্য প্রধান কারণ ‘রাজনৈতিক’। দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিদেশী একটি চক্র দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম মাত্রায় অস্থিতিশীল করতে পেছন দরজা দিয়ে সবকিছু করছে। দুই প্রধান দলকে তারা দু’রকম বার্তা দিয়ে বিভিন্ন সময় নানাভাবে বিভ্রান্ত করেছে, এখনও করছে। এক্ষেত্রে চক্রটি ২০১৪ সালে বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচন থেকে বাইরে রাখতে পেরে বড় সফলতা অর্জন করে।
এর পরের ধাপে বিএনপিকে রাজপথ থেকে বিদায় করে দিতে সক্ষম হয়। সরকারও জনসমর্থনের বাইরে গিয়ে অনেক কিছু আইনশৃংখলা বাহিনী দিয়ে মোকাবেলা করার পথ বেছে নিয়েছে। এর ফলে তৃতীয়পক্ষকে তাদের প্রধান এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। কাট আউট পদ্ধতিতে এখানে তারা জঙ্গি সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে উগ্রবাদ প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। তাদের মতে, যেসব পশ্চিমা গোষ্ঠী গত দু’বছর ধরে বাংলাদেশে আইএস আছে বলে চিৎকার করে আসছে- এসব জঙ্গি সন্ত্রাস তাদেরই সৃষ্টি। এর আগেও তারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে এ ফর্মুলা প্রয়োগ করে সেখানকার গণতন্ত্রসহ সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই এখনও যেটুকু সুযোগ আছে, তা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। তারা মনে করেন, দেশে বর্তমানে যে সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা প্রতিরোধ করতে হলে সত্যিকারার্থে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। শুধু মুখে বললে হবে না- সরকারকে এ উদ্যোগ দ্রুত নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ছাড়া প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক কাতারে আনতে হবে। হাতে হাত ধরতে হবে। বিশেষ করে দুই নেত্রীকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এক কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাতে হবে। আপাতত এর বিকল্প আর কিছু তারা দেখছেন না।
কিন্তু যারা বিষয়টিকে আর দশটা ঘটনার মতো আইনশৃংখলার সমস্যা হিসেবে বিবেচনায় নেবেন তারা চরম ভুল করবেন। ভবিষ্যতে যার চরম মাশুলও গুনতে হবে।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে ১ জুলাই রাতে বিদেশী নাগরিকদের জিম্মি করে জঙ্গিদের উচ্চমাত্রার সন্ত্রাসী হামলায় ২০ জন বিদেশী নাগরিক, ২ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গি সন্ত্রাসের নতুন রূপ প্রকাশ পায়। এর এক সপ্তাহের মাথায় গত বৃহস্পতিবার দেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাতস্থল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় একই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপর একটি টিম সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এখানে বোমা ও গুলিতে পুলিশের দু’জন সদস্য ও একজন সাধারণ মানুষসহ ৪ জন নিহত হয়। পরপর এ দুটি ঘটনায় বাংলাদেশে সন্ত্রাসের চেহারা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভিন্নমাত্রায় প্রকাশ পায়। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা নড়েচড়ে বসেন। একই সঙ্গে দেশে এখন প্রতিটি শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে তীব্র ভয় ও অজানা আতংক ভর করেছে। সংকট উত্তরণে ইতিমধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে পারবে না। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ ষড়যন্ত্রকারীদের কৌশল বাস্তবায়িত হতে দেবে না। আসুন, আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ, জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করি।
অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সব ভেদাভেদ ভুলে দলমত নির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার আহবান জানান। তিনি বলেন, দেশ-জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ আজ বিপন্ন। আমরা যে যাই বলি, আমাদের কিছুই থাকবে না, কোনো অর্জনই টিকবে না যদি আমরা সন্ত্রাস দমন করতে না পারি, যদি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারি। তাই কালবিলম্ব না করে আসুন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি।
সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদও বলেছেন, ‘আগে দেশের স্বার্থ। দেশ রক্ষায় দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।’
এদিকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় একটি সর্বদলীয় বৈঠকের আয়োজন করার দাবি জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি এর আগেও সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে আবারও সেই আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি।’ তিনি আরও বলেন, এদেশে উগ্র সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের বিষয়টিকে আর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এটি এখন ব্যক্তি নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না। দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দেশবাসীর ঐক্য জরুরি। সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, উগ্র সন্ত্রাসবাদ একটি জটিল সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। এছাড়া লক্ষ্য অর্জন শুধু কষ্টসাধ্যই নয়, প্রায় অসম্ভব।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আওয়ামী লীগও ঐক্য চায়। সে লক্ষ্যে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল কাজও করে যাচ্ছে। দেশের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকার জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করবে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত তথা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে ঐক্যের কোনো সুযোগ নেই। কেননা তারাই এদেশে জঙ্গিবাদের ধারক এবং বাহক। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে-সমর্থনে এদেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চলছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। আমরাও মনে করি বর্তমান বাস্তবতায় এবং সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, দোষারোপের রাজনীতি পরিহার করে সরকারের উচিত দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে এক টেবিলে বসা এবং করণীয় নির্ধারণ করা।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ প্রসঙ্গে শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণ করতে সব পক্ষকে নিয়ে বসতে হবে। আর এক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।
দেশের আরেক শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সরকারের উচিত বিষয়টিকে আর হালকাভাবে না দেখা। পরিস্থিতি দিন দিন যেদিকে যাচ্ছে তাতে কেউই এদেশে আর এখন নিরাপদ নন। তিনি বলেন, সরকারের উচিত সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসা। সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ দমনে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, মূলত রাজনৈতিক সংকটের কারণেই দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। আর এদের নেপথ্যে থেকে আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং মদদ দিচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ দেশী-বিদেশী নানা অপশক্তি। তিনি আরও বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য ক্ষমতার মোহে অন্ধ প্রধান দুই দল দেশ পরিচালনায় চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। নানা সময় তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা প্রকট আকারে প্রকাশ পেয়েছে। যার সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রথমত জনগণকে সজাগ করতে হবে। জনগণকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবে এই ঐক্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই। ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলসহ সবাইকে এক হয়ে জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার আহবান জানাতে হবে। তিনি বলেন, বিষয়টিকে এখন আর হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। শুধু আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ মোকাবেলা সম্ভব হবে না। জনগণকে আস্থায় নিয়ে, তাদের ঐক্যবদ্ধ করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের হঠাৎ এই উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক সংকট একটি বড় কারণ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশে গণতন্ত্রহীনতা, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, দুঃশাসন। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজমান চরম হতাশাও সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ উসকে দিচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যক্তিস্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এসে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে আরও বড় ধরনের বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে, যা কারও জন্যই সুখকর হবে না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণকে আস্থায় নিয়ে জঙ্গি মোকাবেলায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, এসব জঙ্গি এখন দেশের যে কোনো স্থানে হামলা চালাতে পারে- এই নির্মম সত্যটা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। সাইফুল হক বলেন, ‘দেশে বিদ্যমান বৈরিতা ও বিভাজন টিকিয়ে রেখে জঙ্গিবাদী এই সন্ত্রাসী তৎপরতাকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, ‘সংকটটি মূলত রাজনৈতিক। তাই রাজনৈতিকভাবে এই সংকট সমাধানে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণকে আস্থায় নিয়ে এই সংকট মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী আক্রমণের যে নতুন মাত্রা ও টার্গেট করেছে তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। পাশাপাশি এদেশের সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ভুলে জাতীয় সংলাপ এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশে জঙ্গিবাদ নেই, আইএস নেই- এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত হয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠান ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বলেন, সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ দমন এখন সরকারের এক নম্বর এজেন্ডা হওয়া উচিত। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
ঃ যুগান্তর